ইসমাইল খান নিয়াজ, সিলেট প্রতিনিধি:
বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর হামলা, হুমকি, হয়রানি এবং হত্যার ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। স্বাধীন মত প্রকাশের দায়িত্বে থাকা সাংবাদিকরা আজ প্রায় প্রতিদিনই আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। চেনা মাস্তান বা অচেনা সন্ত্রাসী, রাজনৈতিক নেতা, জনপ্রতিনিধি বা কখনো পুলিশের হাতেও সাংবাদিকরা আক্রান্ত হচ্ছেন। এভাবে আর চলতে পারে না।
সাম্প্রতিক এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো সাপ্তাহিক দেশের চিত্র পত্রিকার সম্পাদক মুহাম্মদ জাকির হোসাইন লাভলুর বাড়িতে হামলার ঘটনা। গত ২৪ অক্টোবর মৌলভীবাজারে তাঁর বাড়িতে হামলাকারীরা পরিবারকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার লুট করে এবং সরাসরি ভবিষ্যতে সংবাদ প্রকাশ বন্ধ করার জন্য হত্যার হুমকি দেয়। জাকির হোসাইন দীর্ঘদিন ধরে দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছেন। এই সাহসিকতার জন্যই তিনি এবং তার পরিবার বারবার হামলার শিকার হয়েছেন। ২০২৩ সালে তাকে অপহরণ ও নির্যাতন এবং ২০২৪ সালে বাড়িতে আগুন দেওয়া ও পরিবারের ওপর হামলার ঘটনা প্রমাণ করে যে দেশে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কার্যকর নয়।
জাকির হোসাইন নিজে বলেন, “আমি শুধু সত্য লিখেছি। সেই সত্য বলার দায়েই আজ আমার পরিবার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। প্রশাসনের কাছে কোনো সুরক্ষা পাচ্ছি না। দেশে ফিরলে আমার জীবন নিরাপদ থাকবে না।”
সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড এবং হামলার উদাহরণও সাংবাদিকদের নিরাপত্তার দিক থেকে অস্বাভাবিক উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। গাজীপুরে আসাদুজ্জামান তুহিনের হত্যাকাণ্ড এক নির্মম নজির। চাঁদাবাজির সংবাদ প্রকাশের জেরে দুর্বৃত্তরা তাকে কুপিয়ে এবং গলা কেটে হত্যা করে। একই দিনে আনোয়ার হোসেন সৌরভ নামে একজন সাংবাদিককে মারধর করা হয়। তিনি দৈনিক বাংলাদেশের আলো পত্রিকার সাংবাদিক। মারধরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে ঘটে যাওয়া সাংবাদিক হত্যাকাণ্ডও স্বাধীন সাংবাদিকতার ওপর একটি নগ্ন আঘাত। এসব ঘটনা শুধু সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করছে না, সাধারণ নাগরিকের তথ্য জানার অধিকারও হরণ করছে।
দেশের সাংবাদিক নিরাপত্তার পরিসংখ্যানে দেখা যায়, HRSS রিপোর্ট অনুযায়ী, আগস্ট ২০২৫ মাসে অন্তত ১ জন সাংবাদিক নিহত, ৩৩ জন আহত এবং ১১ জন হুমকির মুখে পড়েছেন। Transparency International Bangladesh (TIB) জানায়, আগস্ট ২০২৪ থেকে জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত প্রায় ৪৯৬ জন সাংবাদিক হয়রানির শিকার হয়েছেন। দায়িত্ব পালনকালে তিনজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন, কমপক্ষে ২৪ জন গণমাধ্যম কর্মী পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে, এবং একাধিক সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলের সম্পাদক ও বার্তাপ্রধান বরখাস্ত হয়েছেন। এই সংখ্যাগুলি স্পষ্টভাবে দেখাচ্ছে দেশের সাংবাদিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার তীব্র অভাব।
সাংবাদিকদের ওপর হামলার ক্ষেত্রে আইনের শৃঙ্খলাহীনতা একটি বড় কারণ।
পুলিশ, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দলের প্রভাব ও নীরবতা সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। মামলাগুলো প্রায়ই দীর্ঘস্থায়ী হয়, অভিযুক্তদের দ্রুত গ্রেপ্তার বা শাস্তি হয় না। সাংবাদিকরা ভয় এবং হুমকির কারণে তাদের পেশাগত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেন না। হামলাকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় শাস্তি এড়িয়ে যাচ্ছে।
নিরাপত্তা ও আইনের অভাবে সাংবাদিকরা ভয় ভীতি ছাড়া কাজ করতে পারছেন না। সাংবাদিকরা সমাজে দুর্নীতি, অবৈধতা ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে নজর রাখে। তাদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে সত্য প্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং গণতন্ত্রও ঝুঁকির মুখে পড়ে। এছাড়া আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করতে হলে, সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি; নিরাপত্তা না থাকলে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও প্রতিবেশী দেশের নজরদারি বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের ভাবমূর্তির জন্য ক্ষতিকর।
মিডিয়া সংস্থা এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দ্রুত পদক্ষেপ নেবে, সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে এবং হামলাকারীদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেবে।
সাংবাদিক নিরাপত্তা আইন শুধুমাত্র সাংবাদিকদের জন্য নয়, এটি পুরো সমাজের জন্য অপরিহার্য। আইন বাস্তবায়ন না হলে সাংবাদিকরা আতঙ্কিত থাকবেন, সত্য প্রকাশ থেমে যাবে এবং গণতন্ত্র সংকটে পড়বে। মুহাম্মদ জাকির হোসাইন লাভলুর মতো সাহসী সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এখন সময়ের সর্বোচ্চ দাবি।
সাংবাদিকতা একটি মহান পেশা। এটি কেবল তথ্য পরিবেশন নয়, এটি দেশের গণতন্ত্র এবং মানুষের অধিকার রক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া। সরকারের দায়িত্ব হলো সাংবাদিকদের জীবন ও পেশাগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা—এবং এই দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার কোনো বিকল্প নেই।